Logo
TV
ব্রেকিং নিউজঃ
Friday 18th October 2024
সম্পাদকীয়
শ্রমিকের অধিকার ও নিরাপত্তা সুরক্ষিত হোক
 SUNNEWSBD.COM
 Publish: 01-May-2023

শ্রমিকের অধিকার ও নিরাপত্তা সুরক্ষিত হোক



সভ্যতার রূপায়ণ ঘটেছে শ্রমের বিনিময়। শ্রম করলেই শ্রমিক—এটা যেমন ঠিক, আবার শ্রমিক বলতে প্রথমে শিল্প শ্রমিকের ধারণা এলেও শ্রমজীবী মানুষের বিস্তৃতি আরো অনেক বেশি। কারণ, পৃথিবীর সব মানুষই কোনো না কোনো কাজ করে আর যেকোনো কাজ করতে গেলেই প্রয়োজন হয় শ্রমের। এই হিসাবে পৃথিবীর সব মানুষকেই শ্রমিক হিসেবে অভিহিত করা যায়। কায়িক শ্রম এবং মেধাশ্রম প্রদানকারী উভয়ই শ্রমিক। উভয় শ্রমের বিনিময়ে জীবনধারণ যারা করে তারাই শ্রমজীবী। এক্ষেত্রে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত যেকোনো ব্যক্তি, সে কৃষি বা শিল্প যে ক্ষেত্রই হোক না কেন, তিনিই শ্রমিক। মানুষের শ্রম ও চেতনা এই দুই হলো সব সামাজিক সম্পদের উৎস। তাদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

বর্তমানে শ্রমজীবী সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব প্রকৃত শ্রমজীবী মানুষের হাতে নেই। ফলে কত অসহায় শ্রমিক শোষক সমাজের নিষ্ঠুর পীড়নে নিঃশেষিত হচ্ছে। আরো চিন্তার বিষয় হলো বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার বড় অংশ শ্রমজীবী মানুষ, যাদের বেশির ভাগই আজও অধিকারবঞ্চিত। শ্রমিকেরাই হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে খাদ্য-বস্ত্র উৎপাদন করেন, বাসস্থান নির্মাণ করেন। এই শ্রেণীর লোকদের কঠোর শারীরিক শ্রম ছাড়া নিজেদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করাই মুশকিল হয়ে পড়ে। পৃথিবীর অনেক দেশেই শ্রমিকদের অধিকার-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সনদ আজও পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। যেসব দেশে কার্যকর হয়েছে, সেসব দেশে প্রায়ই তা লঙ্ঘিত হতে দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশেও শ্রমিকের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত নয়, নানা ক্ষেত্রে নানাভাবে উপেক্ষিত। দেশের প্রচলিত আইনে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও অনেক শিশুকে কাজ করতে দেখা যায়। এখনো শ্রমিক শ্রেণী সামাজিকভাবে মর্যাদা অর্জন করতে পারেনি। অথচ কাজ কাজই, তা যে প্রকৃতিরই হোক না কেন। মর্যাদা ও অধিকারের প্রশ্নে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ ও দৈহিক কাজের মধ্যে পার্থক্য করা সভ্যতার পরিপন্থী। দরকার শ্রম ও শ্রমিকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। দেশে শ্রমিকদের জন্য যেসব আইন প্রণীত আছে, তা শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থরক্ষায় যথেষ্ট নয়। এসব আইনকে আরো যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। প্রতি বছর ১৮ লাখ শ্রমিক যুক্ত হচ্ছে শ্রমশক্তিতে। সে অনুযায়ী চাকরির সংস্থান না হওয়ায় অধিকাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। আনুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা কিছু সুযোগ-সুবিধা পেলেও অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা বঞ্চিত। সরকার শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষিত করতে সফল হয়নি এখনো।

খোলা চোখেই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, বর্তমান বাংলায় শ্রমিকের অবস্থানটা কোথায়। প্রথমত, সংগঠিত শ্রমিকেরা আজ কোথায়? শ্রমিকদরদিরা কোম্পানির সঙ্গে আর্থিক এবং সামগ্রী লেনদেনকারী ইউনিয়নের নেতাদের নৈতিক চরিত্র আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। তাদের অকৃপণ দয়ায় আজ বহু কারখানা বন্ধ। বহু জুট মিলের দরজা আজও খোলেনি। আদৌ খুলবে কিনা, তার আশ্বাস কেউ দিতে পারছে না। দ্বিতীয়ত, শ্রমিক সংগঠনগুলো এখন কী করছে? নামকাওয়াস্তে শ্রমিক সংগঠনগুলো আজ রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শ্রমিক-স্বার্থ জলাঞ্জলি দিচ্ছে।

দারিদ্র্যপীড়িত বাবা-মা অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করছেন। উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে শিশুদের ব্যবহার করছেন তারা। মাঝপথে প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের বড় অংশ বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে। যাদের ঠাঁই হচ্ছে শিশুশ্রমিক রূপে, নির্মাণকাজসহ বিভিন্ন অসংগঠিত শিল্পে। এর জন্য সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণই দায়ী। বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সহায়ক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে শিশুরা। ভিক্ষাবৃত্তির কাজেও ব্যবহার করা হচ্ছে এদের। রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে পথশিশুদের দেখা যাচ্ছে। শ্রম আইনে বলা রয়েছে, শিশুদের কয়েকটি নির্দিষ্ট পেশায় এবং কাজে নিয়োগ করা যাবে না। আইন লঙ্ঘন করে কোনো ব্যক্তি কোনো শিশুকে নিয়োগ করলে জেল ও জরিমানার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? আইনে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের বিনামূল্যে এবং আবশ্যিকভাবে স্কুলে পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। জাতীয় শিশুশ্রম নীতি অনুসারে শিশুশ্রমিকদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বিপজ্জনক পেশায় নিযুক্ত শিশুদের পুনর্বাসনে নজর দিয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় যুক্ত করা এবং তাদের বিশেষ স্কুলে পুনর্বাসন করার পরিকল্পনাও গৃহীত হয়। কিন্তু শুধু আইন প্রয়োগ করে সমাধান সম্ভব নয়। শিশুদের বিশেষ বিদ্যালয়ে পুনর্বাসন এবং তাদের পরিবারগুলোর আর্থিক অবস্থার উন্নতিও দরকার।

আন্তর্জাতিক মে দিবসের মূল যে দাবি—৮ ঘণ্টা কাজ করে বাঁচার মতো মজুরি, তা থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতের শ্রমিক মেহনতি মানুষ অনেক দূরে। বেশির ভাগ শিল্প-কারখানায় ন্যূনতম বাঁচার মতো মজুরি, ৮ ঘণ্টা শ্রমদিবস, নিয়োগপত্র, সাপ্তাহিক ছুটি, কাজ ও কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা—এর সব বা অধিকাংশই অনুপস্থিত। শ্রমিক শ্রেণীর বর্তমান গঠনের কারণে সব খাতের শ্রমিকদের মধ্যে অস্থায়ী, দিনভিত্তিক, খণ্ডকালীন, অনানুষ্ঠানিক শ্রমিকের সংখ্যাই এখন বেশি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলেছে। ১৩০ বছর পেরিয়ে যাওয়া অতীতের সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা হয়তো আজ আর নেই। সারা বিশ্বে দৈনিক ৮ ঘণ্টার কাজ নির্ধারিত হয়েছে বহু দিন। জীবনযাত্রার ধরন পাল্টে যাওয়ায় একজন আমেরিকান শ্রমিককে স্ট্যাটাস বজায় রাখতে একই দিনে তিনটি কর্মস্থলে কাজ করতে হয়। সেখানে আর ঘণ্টার হিসাব থাকে না। ধর্মঘট আজ মূল্য হারিয়েছে। প্রতিবাদ জানাতে হলে তা কর্মরত অবস্থায় ব্যাচ ধারণ করে জানাতে হয়। ক্ষতিকর কর্মবিরতি কে চায়?

শ্রমিকের শ্রমে উৎপাদিত হয় ব্যবহার উপযোগী দ্রব্যসামগ্রী কিন্তু তা ভোগ করার অধিকার শ্রমিকের কতটুকু? অর্থনীতির প্রতিটি সূচকের উন্নতি ঘটানোর পেছনেই থাকে শ্রমিকের ঘাম। কিন্তু সবচেয়ে কম পুষ্টি, কম শিক্ষা, কম স্বাস্থ্য সুবিধা, কম বিশ্রাম, কম নিরাপত্তা যেন শ্রমিকদের জন্যই বরাদ্দ। অথচ সারা বিশ্বেই খাদ্য উৎপাদনসহ ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়ছে। বাংলাদেশেও জিডিপি বৃদ্ধির হার, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির পরিমাণ, রফতানি আয় বৃদ্ধিসহ উন্নয়ন যতই বাড়ছে, তার সঙ্গে এ কথাটাও যুক্ত হয়ে থাকছে যে বাংলাদেশ সস্তা শ্রমিকের দেশ। শ্রমিকের মজুরি কম তার কারণ নাকি বাংলাদেশের শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা কম! কিন্তু উৎপাদনশীলতা শুধু শ্রমিকের শ্রমশক্তির ওপর নির্ভর করে না। মেশিন, ম্যানেজমেন্ট এবং ম্যানপাওয়ার এই তিনটিই আছে উৎপাদনশীলতার সঙ্গে। সবচেয়ে যা জরুরি তা হলো শ্রমের মর্যাদা নিশ্চিত করা। শ্রমিক শ্রেণী সামাজিকভাবে মর্যাদা অর্জন করতে পারেনি এখনো।

শ্রমিকদের কাজের ক্ষেত্রগুলো নিরাপদ নয়, মৃত্যুর ঝুঁকি মাথায় নিয়ে শুধু পেটের দায়ে শ্রমিকদের কাজ করতে হয়। বাংলাদেশ লেবার ফোর্স সার্ভে অনুযায়ী দেশের মোট শ্রমিক সংখ্যা ৫ কোটির কাছাকাছি। বাংলাদেশের এই বিশালসংখ্যক শ্রমিকের ভাগ্যোন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতি বছরই আমাদের দেশে মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালিত হলেও এ দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে যারা সবচেয়ে বড় অংশীদার তাদের অধিকারের কথাগুলো সরকার থেকে শুরু করে সবাই ভুলে যায়। ফলে মে দিবস আসে মে দিবস চলে যায় কিন্তু শ্রমিকদের ভাগ্যের উন্নয়ন হয় না। একজন মানুষের জীবন ধারণের জন্য যা যা প্রয়োজন, অর্থাৎ মনসম্পন্ন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এসবই একজন শ্রমিকের প্রাপ্য।

আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের গুরুত্ব¡ ও তাৎপর্য অনুধাবন করে শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে প্রশাসন ও মালিক শ্রেণীকে অনেক বেশি আন্তরিক হতে হবে। মে দিবস পৃথিবীতে বঞ্চনা ও শোষণ থেকে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছে, তা তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে যখন শ্রমিক শ্রেণী তাদের মৌলিক অধিকার ফিরে পাবে। মালিকদের উপলব্ধি করতে হবে শ্রমিকদের ঠকিয়ে শিল্পের বিকাশ বা মুনাফা অর্জন করা যাবে না। শ্রমিকরা দেশের সম্পদ, তাদের কারণে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। এ কারণে তাদের অবহেলার চোখে দেখার কোনো সুযোগ নেই। আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের কাজের অধিকার সুরক্ষা ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।





সাননিউজবিডি ডটকম




এখানে আরও খবর রয়েছে


এই মুহুর্তের শীর্ষ খবর



তারিখ অনুযায়ী খবর দেখুনঃ