Logo
TV
ব্রেকিং নিউজঃ
Tuesday 17th September 2024
ভ্রমন
সুন্দরবন এক মায়াবী জগৎ
 SUNNEWSBD.COM
 Publish: 01-Sep-2018

সাননিউজবিডডিটকম ডেস্ক: ঘুম ঘুম চোখে বাস থেকে নেমেই জানতে পারলাম আমরা মংলা পৌঁছে গেছি। লাগেজের খোঁজ করতেই একজন বললেন, 'সব লাগেজ বোটে তোলা হয়েছে, আরেকটু এগুলেই আমাদের বোট, ঘাটে দুইটা বোট আছে, সবুজ রঙ করা বোটটায় আপনারা ওঠবেন।'

ধাপে ধাপে ক্রমশ নিচের দিকে নামা শান বাঁধানো পথ বেয়ে বোটের কাছাকাছি পৌঁছে পেছন ফিরে দেখি আমাদের পুরো টিমের ৫০ জনকেই দেখা যাচ্ছে। প্রথম সেলফিটা নেয়া হয়ে গেলো সেখানেই। হালকা কুয়াশার আবরণ ভেদ করে ডিমের কুসুমের মত টকটকে লাল কোমল সূর্যটা পূর্বাকাশে ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। ইঞ্জিন বোটে পশুরের জল চিরে এগিয়ে চলছি আমরা। রাতভর দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে খোলা নৌকায় ভোরের শীতল বাতাসও বেশ আরামদায়ক মনে হচ্ছে। কিছুদূর গিয়ে একটা ছোট জাহাজের কাছে বোট থামলো।জাহাজে ওঠে সবার কেবিন বুঝে নিয়ে সুন্দরবনের মধু আর টোস্টেড ব্রেড দিয়ে নাস্তা সেরে আমাদের যাত্রা শুরু হলো।

গাইডের প্রারম্ভিক ব্রিফিং থেকে জানলাম, আমরা সুন্দরবনের সর্ব উত্তর থেকে যাত্রা করে সর্ব দক্ষিণের কটকা নামক স্থানে পৌঁছাবো। মাঝে হাড়বাড়িয়া ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্রে যাত্রা বিরতি করবো।

ত্রিশ মিনিটের পথচলা শেষেই সুন্দরবনের দেখা পেলাম! সে এক বিস্ময়কর আনন্দানুভূতি। দারুণ এক ভালোলাগায় মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ি। আশৈশব যে সুন্দরবনকে বই আর পত্রিকার পাতায় দেখেছি তা প্রত্যক্ষ করার আনন্দ অনির্বচনীয় !

দুপুর বারোটা নাগাদ আমরা হাড়বাড়িয়া পৌঁছাই। হাড়বাড়িয়া নামতেই একদল বানর আমাদের স্বাগত জানায়! জেটির পাশে একটা পরিত্যক্ত ডিঙির উপর বসে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে যাচ্ছিল তারা।শুনেছি বানরগুলো খাবারের লোভে পর্যটকদের কাছাকাছি আসে। বানরের বাঁদরামি উপভোগ করে সবাই লম্বা লাইন করে বনের ভেতর ঢুকে পড়ি। সেখান থেকে সুন্দরবনকে কাছে থেকে দেখার ভালো ব্যবস্থা রয়েছে। ঘন জংগলের ভেতর ভূমি থেকে এক মিটার উচ্চতায় নির্মিত ট্রেইলারে প্রায় দুই কিলোমিটার ঘুরে আসা যায়। গোলপাতা, কেওড়া, সুন্দরী, গরান সহ নাম না জানা আরো নানা বৃক্ষরাজি আর পাখ- পাখালির সান্নিধ্যে দারুণ কেটেছে হাড়বাড়িয়ায়।

হাড়বাড়িয়ার গভীর জংগলের মাঝে বর্গাকার একটি পুকুর রয়েছে যার স্বচ্ছ জলে থরে থরে ফোটা লাল শাপলার অপার সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়েছি।একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে আবার জাহাজে ওঠি এবং সন্ধ্যা নাগাদ কটকায় পৌঁছাই।কটকা খালে জাহাজ নোঙর করে।সে রাতের ভরা পূর্নিমায় মাঝরাত পর্যন্ত জাহাজের ডেকে তুমুল আড্ডা,গল্প আর হাসাহাসির স্মৃতি অমলিন থাকবে বহুদিন।

পরদিন সকাল ছয়টায় শরণখোলা রেঞ্জের কটকা পরিদর্শনে যাই। কটকা হরিণের নিরাপদ আবাসস্থল। কটকার কেওড়া বনে অসংখ্য হরিণের বাস। শুনেছি কেওড়া পাতা হরিণের প্রিয় খাদ্য। কেওড়া বন দূর থেকেই চেনা যায় কারণ বনের হরিণেরা কেওড়া গাছের যতদূর নাগাল পায় সব পাতা খেয়ে নেয়। ফলে মনে হয় পুরো বনের সব গাছ একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় নিখুঁত ভাবে ছেটে রাখা হয়েছে। বনের নিচের দিকটা ফাঁকা থাকায় এখানে সেখানে হরিণের বিচরণ সহজেই চোখে পড়ে। আমাদের গাইড কেওড়া গাছে উঠে পাতাযুক্ত কিছু ডাল ভেংগে নিচে ফেলার সাথে সাথে চারদিক থেকে শতেক হরিণ মুহুর্তে জড়ো হয়ে যায়। বন্য পরিবেশে খুব কাছ থেকে এতগুলো হরিণ একসাথে দেখে আমরা অভিভূত হয়েছি।

সমুদ্র উপকূলবর্তী হওয়ায় ভয়াবহ সিডরের প্রথম ধাক্কাটা সামলেছিল কটকা বন, যার ক্ষত এখনো সারেনি। সেদিন বিস্তীর্ণ এলাকার সব গাছ উপড়ে পড়েছিলো। প্রবল জলোচ্ছ্বাসে মূল ভূমি বালুতে ঢেকে যাওয়ায় সেখানে আর কোন গাছপালা জন্মায়নি ।



কটকা থেকে ফিরে জাহাজে সকালের নাস্তা সেরে জামতলি সি বিচের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। গাইড জানালো বনের ভেতর দিয়ে কয়েক মাইল পথ হাঁটতে হবে তাই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে যেন সবাই রওয়ানা দেয়।জেটি থেকে জংগলে প্রবেশ করতেই গাইড সতর্ক করে বললেন, 'সামনে টাইগারপাস।এই এলাকায় বাঘের আনাগোনা থাকে,সবাই যেন এক সাথে দল বেঁধে চলি।দলছুট হলেই বিপদের সম্ভাবনা।'

এমন কথায় অনেকেরই পিলে চমকে যাবার যোগাড়। বিশেষ করে শিশুদের।বড়রাও কম যায়নি; অনেককেই দেখেছি দলছুট হলেই দৌড়ে দলে ঢুকেছেন!

টাইগারপাস এলাকাজুড়ে ঘন শন ক্ষেত। মাঝ বরাবর দল বেঁধে চলছি আমরা। শন ক্ষেতে শিকারের সন্ধানে ঘাপটি মেরে থাকে বাঘ।এই পথে একা এলে বাঘের ভুরিভোজনে ব্যবহৃত হবার ঢের সম্ভাবনা থাকে।

টাইগারপাস ছাড়িয়ে গভীর জংগলে ঢুকে পড়ি আমরা। সেখানে কোন পথ নেই। আমরা গাছ লতা পাতা এড়িয়ে এলোমেলো হেঁটে চলি। আকাশ দেখা যায় না। গাছের চাঁদোয়ার নীচ দিয়ে ছমছমে পরিবেশে এগিয়ে চলি আমরা। চলতে চলতে হঠাৎ সাগরে ঢেউয়ের গর্জন শোনতে পাই। খেয়াল করতেই দেখি অদূরেই সমুদ্র, আমাদের বঙোপসাগর! সবাই সানন্দে চিৎকার করে উঠি। বন ছেড়ে সাগর তীরে চলে আসি।

এক পাশে বিস্তীর্ন জলরাশি। অপর পাশে সুন্দরবন। সাগরজল আর বনের মাঝে কম করে হলেও দুশ গজের ব্যবধান। সাগরের ফেনিল ঢেউ তার বালুময় মসৃণ সৈকতে আছড়ে পড়ছে। নিজভূমের এমন অপার সৌন্দর্য উপভোগ করার সৌভাগ্য হয়েছে বলে নিজেকে গর্বিত মনে করেছি বার বার।এমন সৌন্দর্যে অবগাহন করার সুযোগ করে দেয়ায় অধ্যক্ষ স্যারের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসায় হৃদয় আর্দ্র হয়ে উঠে।

জামতলি সি বিচে কেউ ভিঁজিয়েছেন পা কেউ ভিঁজিয়েছেন গা। কয়েকজন মেতেছেন ফুটবল নিয়ে আবার কেউ কেউ বিরামহীন সেলফি তুলেই চলেছেন। ছোট ছেলেমেয়েরা সাগর জলে নেমে যেন মহোৎসবে মেতেছে। দলপতি তখন অদূরে গাছের ছায়ায় বসে পরিতৃপ্ত নয়নে সাগর সৈকতে শিষ্যদের জলকেলি দেখছেন।

এই অংশের সৈকত ঘেষে অসংখ্য শহীদের দেহাবশেষ পড়ে থাকতে দেখে খানিকটা বিচলিত হয়েছি আমি! দেশমাতৃকাকে রক্ষায় সিডর,আইলার মত ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামলাতে গিয়ে উপড়ে পড়া অসংখ্য বৃক্ষের ধংসাবশেষকে শহীদই মনে হয়েছে আমার।

সারাদিনের ঘুরোঘুরি শেষে জাহাজে উঠে লাঞ্চ সেরে দু ঘণ্টার বিশ্রাম।সূর্যাস্তের ঠিক আগে সবাই তৈরি হয়ে ইঞ্জিন বোটে উঠি। লক্ষ্য ছোট খাল দিয়ে বনের ভেতরে ঢুকে পাখি দেখবো। খালে প্রবেশ করা মাত্রই ইঞ্জিন বন্ধ করে নিঃশব্দে বৈঠা বেয়ে মাঝি সরু খাল ধরে এগিয়ে চলল।

নির্জন বনে গোধূলি বেলায় ভয়ংকর এক ভালোলাগা(!) বুকে নিয়ে নিঃশব্দে কান পেতে রই। এমন নিস্তব্ধতায় শোনেছি কাছে দূরে থাকা নাম না জানা কতো পাখির বিচিত্র সব হাঁক ডাক,পাখশাটের শব্দে ভয়ে আঁৎকে ওঠেছি কখনো। একটা কাঠ ঠুকরা বিকট শব্দ করতে করতে আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায়।এর এমন গগন বিদারী আওয়াজ শুনে শিশু বয়সী কেউ কেউ কেঁদে ফেলার যোগাড়। আমাদের ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পার হয়ে যায়।

রাতে জাহাজের ডেকের ডাইনিং হলে কেউ সাপলুডুতে, কেউ দাবায়, কেউবা মেতেছে তাস নিয়ে। অন্য এক প্রান্তে অধ্যক্ষ স্যার কয়েকজনকে নিয়ে জমিয়েছেন গল্পের আসর। থেমে থেমে সে কী হাসি! এরই মধ্যে কাপ্তান এসে জানালেন জাহাজ মংলার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে, করমজলের কাছে পৌঁছে রাত যাপন করবে। অধ্যক্ষ স্যার আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে জাহাজের সম্মুখে খোলা ডেকে দাঁড়ালেন। ভরা জোছনায় পশুরের রুচিকর হাওয়ায় মন জুড়িয়ে গেলো নিমিষেই। গল্প, কথা আর আড্ডায় সময় এগিয়ে চলে, সাথে মংলার পথে জাহাজও।

পরদিন খুব সকালে জেগে নাস্তা সেরে সদলবলে করমজল যাত্রা করি।করমজলের বন্য প্রাণি প্রজনন কেন্দ্রে হরিণ, বানর আর কুমিরের দেখা পেয়েছি। তারপর বনের ভেতর নির্মিত কাঠের সরু ট্রেইলারে হেঁটে করমজলের গভীর জংগল চক্রাকারে ঘুরে আবার জেটিতে ফিরে এসেছি।এই পথচলাটা দারুণ উপভোগ্য ছিলো। বিচিত্র উদ্ভিদরাজিতে পূর্ণ এই হরিৎ অরন্যে ঘুরে বেড়ানোই করমজলের প্রধান আকর্ষণ। জেটিতে ফিরে অনির্ধারিত এক ফটোসেশন শেষে জাহাজে ফিরি। মধ্যাহ্নের আগেই মধ্যাহ্নভোজ সেরে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে সবাই ঘরে ফিরি।



ডেস্ক সম্পাদনায়: নাজমুল হুদা





সাননিউজবিডি ডটকম




এখানে আরও খবর রয়েছে





তারিখ অনুযায়ী খবর দেখুনঃ