Logo
TV
ব্রেকিং নিউজঃ
Thursday 21st November 2024
গল্প
বাঁচতে চাই
 SUNNEWSBD.COM
 Publish: 16-Dec-2019

বাঁচতে চাই



সমস্ত রাতটা ধরেই বৃষ্টি পড়ছে। ছমিরদ্দির ঘরের চালটা ফুটো হয়ে গেছে। বউ–ছেলেমেয়ে নিয়ে ছমির ভিজছে। দুদিন পর্যন্ত বৃষ্টি চলছে।

ঘরের বাইরে বৃষ্টির মধ্যেই দাওয়ায় বসে থাকে ছমির। তার যক্ষ্মা। তাই ছেলেটার কাছে যায় না সে। জরিনার কাছেই শুনেছে ছমির, ছেলেটার টাইফয়েড, কাল সকাল থেকে ছেলেটার জ্বর। জরিনা নাকের নথ বন্ধকি দিয়ে ডাক্তার এনেছিল। ডাক্তার বলেছে, ভালো চিকিৎসা না হলে জয়নাল বাঁচবে না। প্যারাটাইফয়েড।

ঘরে পয়সা নেই। দুদিন পর্যন্ত জরিনা উপোস দিয়েছে। জয়নালের চিকিৎসা চলে না। ছোট্ট একটা মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে জরিনা বাইরের ঢেঁকিঘরে কাদামাটি নিয়ে বসে। মাটির জিনিস বানাতে পারলে কাল হয়তো পয়সা আসবে। জয়নালের চিকিৎসা হবে।

খক্ খক্ খক্! কাশির সাথে রক্ত বের হয় ছমিরের মুখ দিয়ে। জরিনা ভয় পায়। ওগো তুমার শরীলডা যে এহেবারে গেল। হাসে ছমির। শুষ্ক হাসি।

: যে ব্যাডা বউ–পোলার ভাত–কাপড় দিতে পারে না, হ্যার আবার বাঁচা! হারাডা জীবন খাডলাম, পাইলাম কী! এহন মরলেই বাঁচি জরি।—জরিনা ছমিরের মুখ চেপে ধরে হাত দিয়ে।

: ওগো তুমি এই রহম কইলে মুই বিষ খামু। তুমি খামাখা ভাবো। মোগো এ দিন থাকবে না। এখন মোগো জয়নাল বাঁচলে অয়।

ছমির বলে, মুই আর কমু না জরি। কসম খাই। তুই জয়নালের হিতানে ব’ আইয়া।

: তুমিও আও না।—জরির কণ্ঠে ব্যথার সুর।

: না, মোর এই রোগে পোয়ার বিছানায় যাওয়া অইবে না।

জরি উঠে যায় জয়নালের কাছে।

একা বসে ভাবে ছমির। সংসারের সমস্ত ঘটনাটা ছবির মতো ভাসে চোখের ওপর। বউ বিষ খাবে। নিজে যক্ষ্মায় মরবে। কাফন দেবারও কেউ থাকবে না। জয়নাল হয়তো বাঁচবে না। একটামাত্র ছেলে। বাপ হয়ে তার ছেলের অসুখে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই। বউ–ছেলের ভাত–কাপড় দিতে পারে না—এমনই অধম সে। অথচ জীবনভর কম খাটেনি সে। খাটতে খাটতে যক্ষ্মা দেহে বাসা বেঁধেছে। কোনো দিন খেটেও পয়সা পায়নি। শ্রমিকের কপালে এই নাকি জোটে। ছেলে হারায়। বউ হারায়। নিজে হারিয়ে যায়। গেলবার বড় ছেলেটা নিউজপ্রিন্ট কারখানায় গেল খাটতে। আর ফিরল না। একটা সংবাদ এল: মজুরি বাড়াবার জন্য শ্রমিকেরা ধর্মঘট করেছিল, মারুফও নেমেছিল মিছিলে। মরল। গুন্ডারা তাকে ছুরি মেরেছে। তারপর মৃতদেহগুলো ট্রাকে করে সরিয়ে ফেলেছে কোথাও।

মৃত্যুসংবাদটা পেল ছমির—মারুফ আর কোনো দিন ফিরে আসবে না। জরিনা অনেক কাঁদল, ওগো তুমার পায়ে পড়ি, মোর মারুফকে ফিরিয়ে আনো।

আর বোধ হয় বাঁচবে না জয়নাল। হঠাৎ মনে হয় ছমিরের, পৃথিবীর সব শ্রমিক যদি এক হয় তবে কি আর পৃথিবীর সব জয়নালকে বাঁচানো যায় না! শ্রমিকদের কিসের জাত, ধর্ম, দেশ, কাল! ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’—এ রকম একটা কথা শুনেছিল ছমির। ছমির ভাবে।

বৃষ্টির শব্দ থেমে গেছে কখন। কখন রাত শেষ হয়ে গেছে। ছমির হঠাৎ জরিনার কান্না শুনতে পায়, ওগো এট্টু আও না, মোর জয়নাল এ রহম করতেছে ক্যা?

দৌড়ে যায় ছমির। জল–কাদায় একাকার হয়ে আছে দাওয়া। একটা কাঠের সিঁড়ির ওপরে শোয়ানো জয়নাল। গায়ে ছেঁড়া–ময়লা একটা কাঁথা। ছমির অবাক হয়ে দেখছে, বাজান মগো ছাইড়া কোথায় গেলি! জয়নাল—জয়নাল গো—

রাত শেষ হয়ে গেল। পৃথিবী আলোকিত হলো। পাখি ডাকল।

‘বাঁচার মতো বাঁচতে চাই, অন্ন বস্ত্র শিক্ষা চাই’ বলে কারা হাতে হাত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এ রাস্তায় আসছে। মেয়ে–পুরুষ একত্রে। ছমির চিনতে পারে, চটকলের শ্রমিকেরা। পায়ে পায়ে হেঁটে আসছে তারা। ছমিরের মনে পড়ে, আজ পয়লা মে! এই দিনটায় তো প্রত্যেক বছর মিছিল নেমেছে। শ্রমিকেরা দাবি জানিয়েছে। বাঁচতে চাই। এই তো মুক্তির পথ। ছমির দৌড়ে মিছিলে নামে। চলতে চলতে ভাবতে থাকে, কী বলা যায়। হঠাৎ শুনতে পায় কে যেন বলছে, ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও।’ চিৎকার করে ওঠে ছমির, ‘এক হও, এক হও।’ বাঁচতে চাই—এ কথার জন্যই যেন ছমিরের মনে হয়, পৃথিবীর সব শ্রমিক আজ এক হলে জয়নালের মতো শত শত জয়নাল বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে না। এ দিনেই জয়নাল বাঁচবে। হঠাৎ চোখ পড়ে ছমিরের, মিছিলের শেষ দিকে মেয়েদের মাঝে জরিনার কাপড়ের আঁচলও উড়ছে। বাঁচার জন্য জরিনাও আজ ঘর ছেড়ে মিছিলে নেমেছে। সবার তাগিদ এক—বাঁচার মতো বাঁচতে চাই।

মুক্তির অন্বেষা নামে একটি পত্রিকায় শশাংক পালের গল্পটি পাওয়া গেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সৌজন্যে





সাননিউজবিডি ডটকম




এখানে আরও খবর রয়েছে


এই মুহুর্তের শীর্ষ খবর



তারিখ অনুযায়ী খবর দেখুনঃ



সর্বাধিক পঠিত